‘ঘুরে দেখা পৃথিবী’ স্পেনে মিনারের সুর
নিয়াজ মাখদুম:
স্পেনে আবৃত মিনারের সুর করেছে। মসজিদের ভুল কিবলায় প্রতারিত হচ্ছে না সে দেশের মুসলমানরা।(১) ভ্রমণপ্রিয় টুরিস্টদের তারা জানিয়ে দিচ্ছেন সঠিক কেবলার দিক।সহীহ কেবলার মসজিদ গড়ছেন স্পেনের মুসলমানরা। ‘হাইয়ালাস সলাহ’ ডাকে সাড়া দিয়ে স্থানীয়রা দলে দলে শরিক হচ্ছেন জামাতে। সে দেশে ইসলামে রিভার্ট এবং ইমিগ্র্যান্ট মুসলিমদের সংখ্যা বাড়ছে প্রতিদিন। কমিউনিটি ভিত্তিক মসজিদ, মকতব, পাঠাগার, ইসলামী জনকল্যাণমূলক সংগঠন এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকুরীতে অবদান রাখতে শুরু করেছেন স্পেনের মুসলিম কমিউনিটি। এ যেন পাথর চাপা ইতিহাসের আলোকচ্ছটা স্পেনের অলিতে গলিতে নতুন করে ঝিকিমিকি রশ্মি ছড়াতে শুরু করেছে।
স্পেন বর্তমানে বিশ্বের ভ্রমণপ্রিয় মানুষদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। ২০১৮ সালে প্রায় ৮৩ মিলিয়ন মানুষ ভ্রমণ করায় দেশটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ সংখ্যক ভিজিটরদের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায়।এ বছর প্রথম হয়েছে ফ্রান্স; যার ট্যুরিস্ট সংখ্যা ছিল ৮৯ মিলিয়ন।(২)
ভিজিটরের সংখ্যা যাই হোক ভ্রমণের ক্ষেত্রে স্পেনের কথা আসলে ভ্রমণ প্রিয়দের মনে সেদেশের চোখ জুড়ানো দৃশ্যপট, আবিস্কার, ঐতিহ্য, শৈল্পিকতা, সভ্যতা, প্রাকৃতিক সৌন্দয্য, ইতিহাস, ধর্মানুভূতি- এমন অনেক বিষয় একসাথে জেগে ওঠে, যা অন্যত্র বিরল। আর মুসলমানদের ক্ষেত্রে স্পেনের নাম উচ্চারিত হলে হতাশার দীর্ঘশ্বাস শোনা যায় অনেক কণ্ঠে। প্রায় আট শত বছরের (৭১১-১৪৯২ খৃ:) ঐতিহ্য কেন হারিয়ে গেল? যে ঈমানী শক্তিবলে ইসলামের বীর সেনানীরা অত্যাচারী শাসকদের দাম্ভিকতা থামিয়ে দিয়েছিলেন? শান্তি খুঁজে পেয়েছিল মানবতা। সভ্যতার জ্যোতির্ময় আবিষ্কারে যারা দিশারীর ভূমিকা পালন করেছিলেন।যাদের ত্যাগ, ভালবাসায় ইসলামের সৌরভ সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল। এমন কি ঘটেছিল, যে ভুলে দীর্ঘ দিনের অর্জন ধূলায় লুটিয়ে গেল! সে গৌরব কি আর ফিরিয়ে আনার কোন উপায় নেই?আজকের মুসলিম বিশ্ব যে অনিশ্চয়তার তিমিরে দাঁড়িয়ে, তারা কি পারবে সে ঈমানী শক্তির রশ্মিছটা প্রজন্মের মাঝে জ্বালাতে?
‘সী-রু ফিল র্আদ…’ পৃথিবী ভ্রমণ কর। আল্লাহ পাকের নির্দেশ মাথায় থাকায় ‘কাবা’ এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মসজিদে নববী ভ্রমণের পর থেকে পৃথিবীর সম্ভাব্য দর্শনীয় স্থানগুলো ভ্রমণের স্বপ্ন অনেক দিনের। বিশেষ করে মুসলিম ঐতিহ্যের পদচিহ্নগুলো। বন্ধুদের সাথে এনিয়ে কথাও বলেছি। সম্মতি প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ; কিন্তু শুরু করা সম্ভব হয়নি। হঠাৎ একদিন ফোনে ‘টুং’ শব্দে একটি টেক্সট মেসেজ ভেসে উঠলো।তাকিয়ে দেখি ডা. সাঈদুর রহমান চৌধুরী লিখেছেন- ‘স্পেন ভ্রমণের পরিকল্পনা করেছি। ৬ জনের টিমে আপনিও একজন সদস্য। যাবেন কি?’ ডা. সাঈদুর রহমান চৌধুরী পেশায় একজন চিকিৎসক ও এনেসথিওলজিস্ট হলেও ইসলাম এবং সমসাময়িক বিশ্ব নিয়ে তথ্যসমৃদ্ধ, সচেতন মানুষ। তাঁর সাথে ভ্রমণের অফার পেয়ে পুলকিত হলাম। মনের ক্যানভাসে এতদিন যে বিষয়টি নিয়ে ছবি আঁকছিলাম, করুণাময়ের অশেষ অনুগ্রহে মুঠো ফোনে ভেসে উঠলো সে বার্তা। অবর্ণনীয় অনুভূতি! উত্তর পাঠালাম- ‘আপনি যদি যান, অবশ্যই যাবো, ইনশাআল্লাহ’। তিনি রাজি হলেন কিন্তু শর্ত জুড়িয়ে দিলেন;-স্পেন নিয়ে পড়তে হবে, নোট নিতে হবে এবং লিখতে হবে। রাজি হলাম। হোয়াটস আপ-এ ‘জার্নি টু স্পেন’ গ্রুপ করা হল।ভ্রমণসঙ্গী গ্রুপের সদস্যরা ছিলেন- ডা. সাঈদুর রহমান চৌধুরী, খায়রুল হাসান রফিক, কোরবান সানি, আহমাদ আবু ওবায়দা, মোহাম্মদ রাশেদুজ্জামান এবং নিয়াজ মাখদুম। স্পেন ভ্রমণের ‘এ টু জি’ বিষয়ে পাঁচ জনকে দায়িত্ব বন্টন করে দেয়া হল। আর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের কাজটি করলেন দলনেতা ডা. সাঈদুর রহমান চৌধুরী।তিনি ‘জার্নি টু স্পেন’ গ্রুপে কখনো প্রশ্ন ছুঁড়ে পুরস্কারের কথা ঘোষণা করলেন।কখনো স্পেনের ইতিহাস নিয়ে ‘হাই-লাইটস’ পাঠালেন। কয়েক মাস পূর্ব থেকেই শুরু হয়ে গেল স্পেন ভ্রমণের অনুভূতি। ভ্রমণ অভিযান ছিল ২২ নভেম্বর থেকে ২৮ নভেম্বর, ২০১৯ পর্যন্ত।
স্পেন ভ্রমণ ও ইতিহাস সংক্রান্ত বই, ইলেট্রনিক তথ্য এবং স্পেনে বসবাসকারীদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করা হল। উদ্দেশ্য স্পেনে হারিয়ে যাওয়া মিনারের সুর এবং বর্তমান মুসলিম দৃশ্যপটের তথ্য উদঘাটন। রিক স্টিভ, ফডরস ট্রাভেলস, লনলি প্লানেটের ডিসকোভার স্পেন সহ অন্যান্য টুরিজমনের বই থেকে স্পেনের দর্শনীয় স্থানগুলো, ভ্রমণের সুযোগ-সুবিধা, নিয়ম-কানুন, কোথায় কি পাওয়া যাবে ইত্যাদি সম্পর্কে একটা মৌলিক ধারণা জানা গেলেও স্পেনে সেকালের (৭১১-১৪৯২খৃ:) মুসলমানদের ইতিহাস জানতে গিয়ে মাকড়শার জালের একেক ভাঁজে আটকে যাই। পূর্বের ইতিহাসে এক রকমের বর্ণনা, পরের বর্ণনায় ভিন্ন তথ্য, বর্তমানের বর্ণনাভঙ্গি অন্য স্বাদের!ইতিহাস এমনই হয় বলে আগেও শুনেছি।এছাড়া স্বীকৃত উক্তি হল- ‘অলোয়েজ উইনার্স রাইট হিস্ট্রি’- সব সময় বিজয়ীরাই ইতিহাস রচনা করে। তাই এর সত্য উদ্ঘাটন সত্যি দুরূহ বিষয়। আর যারা বিচক্ষণ তারা নিজেদের পছন্দের ইতিহাস রচনার পূর্বে অন্যদের সকল অবদান, ইতিহাস এবং তথ্য সামগ্রীর চিহ্ন দক্ষতার সাথে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। যেমনটি করেছিলেন স্পেনের ক্যাথলিক খৃষ্টান রাজা ফার্ডিন্যান্ড এবং রানী ইসাবেলা। তারা ক্ষমতায় আরোহণের পর সর্বপ্রথম যে অর্ডিন্যান্স জারি করেছিলেন, তা ছিল- সকল মসজিদকে গীর্জায় রূপান্তর করা এবং মুসলমানদের যাবতীয় ইতিহাস, রিসার্চ, সাহিত্য ধ্বংস করে দেয়া। যার ফলে সুদর্শন উঁচু মিনারগুলো ‘ক্রস’ এবং ঘন্টার আবরণে ঢেকে যায়, মসজিদগুলো বিভিন্ন ধরনের মূর্তি এবং ধর্মীয়ানুভূতি বিবর্জিত অঙ্গসজ্জায় রূপ নেয় মিউজিয়ামে। আর মুসলিম ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং রিসার্চ সেন্টারগুলো বিলীন হয় সারি বাধা শুকরের রান, মদ ও মনোরঞ্জন গিফ্ট আইটেমে! এ কাজগুলো তারা এত নিপূণ ভাবে করেছিলেন যে, আজো সমগ্র স্পেনের মসজিদগুলো দূর থেকে মসজিদ আকৃতির মনে হলেও তার নিকটবর্তী হওয়ার সাথে সাথে দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে তাদের চাপিয়ে দেয়া ধর্মের প্রতিচ্ছবি।
স্পেনের ইতিহাস এবং এর রূপ সৌন্দর্যের ছবি মনের পর্দায় আঁকতে আঁকতে সফরের দিনক্ষণ ঘনিয়ে এলো।টুরিজমের বইগুলোতে ভ্রমণের পরিকল্পনা, ভ্রমণ স্থানগুলোর সচিত্র প্রতিবেদন, থাকা-খাওয়া-শপিং-ভ্রমণের স্থানগুলো ইত্যাদি বিষয়ের বর্ণনা থাকলেও হালাল খাবার, মসজিদ, মুসলমানদের উপযোগী শপিং প্লেস কিংবা মুসলিম কমিউনিটি সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য না থাকায় ভ্রমণ পরিকল্পনা আমরা নিজেরাই তৈরি করি।
স্পেনে ভ্রমণকারীদের পদচারণা বছরব্যাপী হলেও মুসলমানদের জন্যে উপযুক্ত সময় উইন্টার। প্লেন এবং হোটেল ভাড়া অন্য সময়ের চেয়ে কম থাকে।অনৈসলামিক অসভ্যতার ছড়াছড়িতে থাকে ভাটির টান। শিক্ষার্থীদের টিম এ সময় বেশী চোখে পড়ে। গাইটদের ব্যস্ততা কম থাকায় ইতিহাস নিয়ে খোলামেলা মতবি-িনময় করা যায়। টুরিস্ট ট্রাফিকজ্যাম থাকেনা বলে স্পটগুলো প্রাণভরে উপভোগ করা যায়।
(১) কর্ডোভার জামে মসজিদ এবং ঐ মসজিদ সংলগ্ন বাজারে একই ডিজাইনের ছোট্ট আকৃতির যে মসজিদটি রয়েছে, কম্পাস অনুযায়ী তার কিবলা ‘কাবা’ মুখী নয়।
(2) https://www.worldatlas.com articles › 10-most-visited-countries-in-the-world
(পরের অংশে চোখ রাখার অনুরোধ রইল)
-জানুয়ারী ৩, ২০২০ বাফেলো, নিউইয়র্ক
Comments