‘বাফেলো বাংলার সাথে চিকিৎসা বিজ্ঞানী ডা.নাজমুল হাসান খান’ ক্যান্সার নিরাময়ে নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি ইমিউনোথেরাপি
বাফেলোবাংলা রিপোর্ট: সম্প্রতি বাফেলো বাংলা’র সাথে ক্যান্সারের নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি ইমিউনোথেরাপি নিয়ে কথা বলেছেন সিনিয়র চিকিৎসা বিজ্ঞানী ডা.নাজ-মুল হাসান খান। তিনি দু’ যুগেরও অধীক কাল যাবত গ্রেটার বাফেলোর বাসিন্দা। আমেরিকার বিখ্যাত রোজেল পার্ক কম্প্রিহেনসিভ ক্যান্সার সেন্টারের সিনিয়র সায়েন্টিস্ট হিসেবে এ থেরাপি নিয়ে গবেষণা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন এবং একই সাথে এর ব্যাপ্তি বাংলাদেশ পর্যন্ত পৌঁছে দিতে তিনি নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে বাফেলো বাংলার সম্পাদক নিয়াজ মাখদুমের সাথে কথপোকথনে জানান।ইমিউনোথেরাপি ও পার্সোনালাইজড মেডিসিন নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্টিং মিডিয়াতে ডা. এস এন এম নাজমুল হাসান খান চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেন যা বাফেলো বাংলার পাঠকদের জন্যে তুলে ধরা হল-
ক্যান্সারের পরিচয় দিতে গিয়ে ডা. নাজমুল হাসান বলেন, সংক্ষেপে বলতে গেলে- মানুষের শরীরের কোষ বা সেলের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিই ক্যান্সার। এ অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে একটি সেল থেকে অনেকগুলো সেল বৃহদাকারে জন্ম নিয়ে হতে পারে ক্যান্সার। মূলত: ক্যান্সার অ-িনয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজন সংক্রান্ত রোগসমূহের সমষ্টি। এখনো পর্যন্ত এই রোগে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। কারণ, প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার রোগ সহজে ধরা পড়ে না বা নির্ণয়ে ব্যর্থতার কারণে শেষ পর্যায়ে গিয়ে ভালো কোনো চি-কিৎসা দেয়া সম্ভব হয় না।
ক্যান্সারের নতুন চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে ক্যান্সারের নতুন চিকিৎসাপদ্ধতি এখন পর্যন্ত চালু না হলেও পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ক্যান্সারের নতুন কিছু চিকিৎসাপদ্ধতি চালু হয়েছে। প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতি তো আছেই।নতুন চিকিৎসাপদ্ধতির মধ্যে রয়েছে-অপারেশন, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি ইত্যাদি। এছাড়াও বেশকিছু আধুনিক চিকিৎ-সাপদ্ধতি প্রক্রিয়াধীন; যেমন: ইমিউনোথেরাপি, পার্সোনালাইজড মেডিসিন ইত্যাদি।ইমিউনোথেরাপি হলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে ক্যান্সার সেল প্রতিরোধ বা হত্যা করা। এছাড়া, ইমিউনোথেরাপির সহায়তায় পার্সোনালাইজড মেডিসিন উদ্ভাবন। এর মাধ্যমে আমরা সহজেই বুঝতে পারি, রোগীর শরীরে কোন ধরনের জেনেটিক ত্রুটির ফলে এটি হচ্ছে এবং কোন চিকিৎসা ওই ব্যক্তির জন্য কার্যকর হবে।
বিষয়টির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ইমিউনোথেরাপি ও পার্সোনালাইজড মেডিসিন হচ্ছে ক্যান্সার নিরাময়ে একটি নতুন চিকিৎসা ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে অ্যাক্টিভেট করে ক্যান্সার সেলকে ধ্বংস করা হয়; কিংবা ক্যান্সার সেলকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, যাতে শরীরে ক্যান্সার আর বাড়তে না পারে। অর্থাৎ, ইমিউনোথেরাপি চিকিৎসা পদ্ধতি শুরুতেই ক্যান্সার সেলের গ্রোথকে কমিয়ে দেয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্যান্সার সেলকে ধ্বংস করে। প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেয়ার পর প্রতিকারমূলক চিকিৎসার মাধ্যমে ক্যান্সার নিরাময় করা হয়। রক্তের পরীক্ষার মাধ্যমে বায়োমার্কার চেক করে আমরা নির্ণয় করতে পারব কারোর ওভারিয়ান ক্যান্সার সম্পর্কে। পাশাপাশি আরো জানা যাবে, তাকে এখন কোন পর্যায়ের চিকিৎসা প্রদান করা যেতে পারে। এসব হচ্ছে ইমিউনোথেরাপি চিকিৎসাব্যবস্থার মূল কনসেপ্ট।ইমিউনোথেরাপির সবচেয়ে ভালো বিষয় হচ্ছে- এই চিকিৎসা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন।
প্রসঙ্গত তিনি ২০১৮ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী যুক্তরাষ্ট্রের জেমস পি অ্যালিসন ও জাপানের তাসুকু হোনজো’র ইমিউনোথেরাপি পদ্ধতি নিয়ে বলেন, জেমস পি অ্যালিসন ও তাসুকু হোনজো মানবদেহের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে উদ্দীপ্ত করে ক্যান্সার কোষকে প্রতিহত করার জন্য ‘ইমিউন চেকপয়েন্ট থেরাপি’ ব্যবহারের বিভিন্ন পন্থা দেখিয়েছেন। তাঁদের আবিষ্কার করা এ পদ্ধতিটি খুবই কার্যকরী। দেখা গেছে, প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থার চেয়ে ‘ইমিউন চেকপয়েন্ট থেরাপি’ পদ্ধতিটি রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমেরিকা এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এই চিকিৎসা পদ্ধতি এখন অনেক বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে।
কি কি কারণে ক্যান্সার হয় এবং এর নির্ণয়ের পদ্ধতি সম্পর্কে ডা. নাজমুল হাসান বলেন, নানা কারণে ক্যান্সার হতে পারে, যেমন: জেনেটিক বা বংশগত, পরিবেশগত, ভাইরাসগত, খাদ্যাভ্যাসগত এবং রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে আসার কারণে।আবার ক্যান্সার নির্ণয়ে বেশকিছু টুলস বা যন্ত্রপাতিও রয়েছে, যার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে ক্যান্সার হয়েছে কি না।এছাড়া, নতুন সংযোজিত সিস্টেমও রয়েছে, যেমন: জেনেরিক টেস্টিং। এর মাধ্যমে মানব দেহে ক্যান্সারের উপস্থিতি জানা যায়।সুতরাং আমাদের উচিৎ যথাসম্ভব ক্যান্সার হওয়ার কারণগুলো এড়িয়ে চলা। ব্রেস্ট ক্যান্সার থেকে রক্ষার জন্য রয়েছে সেলফ এক্সাম, মেমোগ্রাফি, স্কিন টেস্ট ইত্যাদি। যদি আমরা এগুলো নিয়মিত গুরুত্বের সাথে মেনে চলি, তাহলে এ মরণব্যাধি থেকে আমরা অনেকাংশে মুক্তি পেতে পারি। আমরা যদি প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করতে পারি যে ক্যান্সার হয়েছে, তাহলে নিরাময় অনেকটা সম্ভব। তবে স্টেজ-৩, ৪ এ চলে গেলে তখন আসলে অধিকাংশ সময়ই করার তেমন কিছুই থাকে না। এজন্য দরকার জনসচেতনতা। রোগাক্রান্ত হয়ে গেলে, অবশ্যই ক্যান্সার চি-কিৎসকদের সাথে পরামর্শের মাধ্যমে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে।
ক্যান্সারের আধুনিক চিকিৎসা বাংলাদেশের মানুষ কিভাবে পেতে পারে প্রশ্নের উত্তরে চিকিৎসা বিজ্ঞানী নাজমুল বলেন, আমি চাই বাংলাদেশের সব মানুষ সঠিক এবং আধুনিক ক্যান্সার চিকিৎসা গ্রহণ করুক। আর সে লক্ষ্যেই বাংলাদেশে একটি সেন্টার ফর পার্সোনালাইজড মেডিসিন এবং ইমিউনোথেরাপি চালু করার লক্ষ্যে কাজ করছি। যুক্তরাষ্ট্রের মত উন্নত বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে সমন্বয়ের মাধ্যমে সঠিক ক্যান্সার চিকিৎসা নিশ্চিত করা এবং এর মাধ্যমে যুগান্তকারী সাফল্য অর্জিত হবে বলে আমি মনে করি।
আপন গবেষণাকর্ম সম্পর্কে সিনিয়র সাইনটিস্ট ডা. নাজমুল আলম খান বলেন, আমার কাজগুলো সাধারণত প্রি-ক্লিনিক্যাল।প্রি-ক্লিনিক্যাল বলতে আমি চামড়ার বিভিন্ন মডেল সিস্টেমের কাজ করে যাচ্ছি। সেই সাথে রয়েছে রক্তের সেলের ক্যান্সার বিষয়ে কাজ। এছাড়াও মেলানোমা নামক এক ধরনের স্কিন ক্যান্সার নিয়েও আমি কাজ করেছি। গত পাঁচ বছর ধরে আমি যুক্ত আছি ওভারিয়ান ক্যান্সার সম্পর্কিত কাজের সাথে। এ রোগে মৃত্যুর হার খুবই বেশি এবং এর কোনো চিকিৎসা এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। এ রোগে মৃত্যুর প্রধান কারণ, রোগীরা চূড়ান্ত পর্যায়ে ডাক্তারের কাছে আসেন। রোগ নির্ণয় বিলম্বিত হওয়ায় চিকিৎসাও অসম্ভব হয়ে পরে। আর প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজন স্ক্রিনিং টুলস, কিন্তু সেটা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তবে সেই টুলস ডেভেলপ করাই আমার কাজ। এছাড়া, ওভারিয়ান ক্যান্সার নিরাময়ে ইমিউনোথেরাপির কাজটিও আমি বর্তমানে করে যাচ্ছি।
মরণব্যাধী ক্যান্সার সম্পর্কে বাফেলো সহ যুক্তরাষ্ট্রের সকল বাংলাদেশীদের সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন বাংলাদেশের গর্ব রোজেল পার্ক কম্প্রিহেনসিভ ক্যান্সার সেন্টারের সিনিয়র সায়েন্টিস্ট ডা. এস এন এম নাজমুল হাসান খান।