Monday, October 2, 2023
First Bangla Newspaper In Buffalo,NY


‘মমতার বন্ধন’

By বাফেলো বাংলা , in Blog Buffalo Winter , at জানুয়ারি 6, 2020

এইচ.এম. মুশফিক:
চিত্রনাট্য (১)
তিন বেড রুমের একটি ফ্ল্যাট প্রতিটি রুমই অন্ধকার, রাত প্রায় ৩টা। হালকা নিয়ন বাতীর আলোতে একটু আধটু ছায়ার মতো দেখা যায়। দক্ষিণ-মুখী ফ্ল্যাটের একদম
পেছনের বারান্দার সাথে লাগানো রুমে শুয়ে আছেন এই ফ্ল্যাটের মালিক ইউএস থেকে পিএইচডি ডিগ্রীধারী ড. হাতেম আলীর বৃদ্ধ বয়সী বাবা মা। অন্যরুমে আছেন তারই ড. পুত্র সদ্য বিবাহিত হাতেম আলী ও তার ডাক্তার স্ত্রী রেবেকা খন্দকার।
রাতের আধারে হঠাৎ কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনে ঘুম ভেঁঙ্গে যায় বৃদ্ধ বাবা রাকেশ খান ও বৃদ্ধা মা আলেয়া খানের। দু’জনই ওঠে পড়লেন, মশারী সরিয়ে বেরিয়ে এলেন। লাইট জ্বালিয়ে বিরক্তি ভরা চোখে বলে উঠলেন- ‘উফ! এই ছিলো কপালে? এই বয়সে এসে কুকুরের পাশের রুমে ঘুমোতে হবে জানলে…।’
এতটুকু বলতে না বলতেই আধো আধো ঘুম ঘুম চোখে মশারীর ভেতর থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে স্বামীর মুখ চেপে ধরে বৃদ্ধা আলেয়া খান বললেন ‘প্লীজ অলুক্ষণে কোন কথা বলোনা, এটা আমাদের নিয়তি!’ এই বলে স্বামী স্ত্রী দু’জনেই একজন অপর জনের চোখে চোখ রেখে দু’ফোটা আবেগের উষ্ণ জল ছেড়ে দিলেন। রুমের ভেতরটা একটা খাট পাশে একটা সাধারণ টেবিলে কিছু ছড়ানো ছিটানো কাগজ-বই আর একটা টেবিল ল্যাম্ফ। বৃদ্ধ রাকেশ খান প্রিয়তমা স্ত্রীর চোখের জল মুছে দিয়ে নিজেদের রুমের দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন, স্বামীর পিছু নিলেন স্ত্রী। খুব সন্তপনে দরজাটা খুললেন। টুক করে একটু শব্দ হলো- দরজাটাকে হা করে দিয়ে পিনপতন নিরবতায় পা পা করে খুব সাবধানে এগিয়ে গেলেন। একটু এগুতেই দেখলেন, ‘বিদেশী কুকুরটা’ তার রুমে পায়চারী করছে, যাকে বলে জার্মান শেফার্ড। রাতের নিয়ন আলোতে দু’জন মানব মানবীকে দেখে জার্মান শেফার্ড যেনো আরো উত্তেজিত হয়ে ওঠলো। কুকুরের উত্তেজিত হয়ে ওঠা দেখে বৃদ্ধ বৃদ্ধা দু’জনেই ভয়ে গুটিসুটি পা ফেলে এক প্রকার দৌড়ে নিজেদের রুমে ঢুকলেন।
চিত্রনাট্য (২)
কুকুরের উত্তেজিত হওয়া চিৎকার আর ফোঁস ফাস শব্দে কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে মেজাজটা খিটখিটে হয়ে ওঠে ডক্টর দম্পত্তির। দু’জনেই ওঠে আসে, পরনে নাইট ড্রেস আর মুখে বিরক্তি। হুড়মুড় করে দরজা খোলেন হাতেম আলী। খুব দ্রুত পায়ে হেঁটে কুকুরের রুমের সামনে আসেন। স্বামীকে অনুসরণ করেন স্ত্রী- ডাক্তার রেবেকা খন্দকার।স্বামীর পেছন পেছন আসতে আসতে রেবেকা বলছিলেন স্বামীকে লক্ষ্য করে ‘‘নিশ্চয়ই আজও তোমার বাবা মা বোধ হয় ‘টম’কে কিছু করেছে।’ ‘হয়তো বা দেখি আগে চলো’ বলে স্বামী ডক্টর হাতেম আলী খুব দ্রুত সামনে পা ফেলছেন।
হাজবেন্ড ওয়াইফ কুকুরের রুমের সামনে এসে কুকুরের মুখোমুখী দাড়াতেই কুকুরটা প্রশ্রয়ী ভঙ্গিতে কয়েকটা ঘেউ ঘেউ শব্দ করলো।মনে হলো- বস তার অধীনস্তকে কিছু আদেশ করল, ডক্তর হাতেম আলী যেনো তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। দাঁতে দাঁত চেপে সে বাবা মায়ের রুমের দিকে কড়া মেজাজে তাকালেন, এক দু’সেকেন্ডের জন্য কিছু একটা ভাবলো সে, তারপর বাবা মায়ের রুমের দিকে ছুটলো।
চিত্রনাট্য (৩)
বাবা মা’র রুমের কড়া ধরে নাড়ছে ডক্টর হাতেম আলী। পেছনে তার স্ত্রী দাড়িয়ে। দু’তিন বার নাড়ানোর পর দরজা খুললেন বৃদ্ধ বাবা। তোমরা কি কুকুরটাকে শান্তিতে একটু ঘুমোতে দেবে না? তিরিক্ষ মেজাজে কথাগুলো বললেনন ছেলে ডক্টর হাতেম আলী। বৃদ্ধ বাবা অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলেন ছেলের দিকে। বৃদ্ধা মা স্বামীর পাশে দাড়িয়ে, বৃদ্ধা কিছু একটা বলতে যাবেন এমন সময়ই ছেলেটা ঘাড় বাকিয়ে চলে যায় খুব দ্রুত।

চিত্রনাট্য (৪)
ছেলের বলে যাওয়া কথাগুলো কানে বাজছে বার বার। ‘তোমরা কি কুকুরটাকে শান্তিতে ঘুমোতে দেবে না?’ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন বৃদ্ধ রাকেশ খান। স্বামী স্ত্রী দু’জন পাশাপাশি বসে আছেন। বৃদ্ধা আলেয়া খান খাটে ওঠে কাত হয়ে শুয়ে পড়ার ভান করলেন। বৃদ্ধ রাকেশের মনটা ভারী হতে থাকে ভাবনার পাখীগুলো উড়ে বেড়ায় মনের কিনারায়। কত কথা মনে পড়ে যায়। কত স্বপ্ন কত আবেগ কত কি বিলাশীতার স্বপ্ন ছিলো- একমাত্র ছেলেকে ঘিরে। মনের পাখীরা ওড়ে যায় সেই পেছনে নস্টালজিয়ায় পেয়ে বসে মি: রাকেশ খানকে।
আজ যেই ছেলে তাকে ইংরেজীতে ধমকায়, সেই ছেলের নরম কচি হাত ধরে তাকে একদিন হাটা শিখিয়েছি। যেই মুখে আজ আমাদের ধমকায় সেই মুখে আদর করে কত হাজার বার খাবার তুলে দিয়েছি। যেদিন প্রথম স্কুলে দেই আমরা তার বাবা মা সারাটা দিন তারই ক্লাসের সামনে একটি বেঞ্চে বসে কাটাতে হয়েছে। কারণ আমাদের দেখতে না পেলেই সে কাঁদতো। আস্তে আস্তে আমাদের হাতেম স্কুলে একা বসতে থাকতে ও পড়তে অভ্যস্থ হলো। প্রতিদিন হাত ধরে নিয়ে যেতাম, স্কুল ছুটি হলে আবার নিয়ে আসতাম। ধীরে ধীরে সে ফিফথ গ্রেড এইটথ গ্রেড নবম দশম একাদশ এবং ফাইন-াললী সে শেষ করলো তার এইচ এস সি। আমাদের সেই ছোট্ট হাতেম চোখের সামনে দিয়ে পলকের মতো যেনো হয়ে গেলো পরিপূর্ণ যুবক।
অবজ্ঞা করে হাজারো বার বন্ধু রহমানকে বারন করেছিলাম ছেলেকে মাদ্রাসায় দিস না। না কে শোনে কার কথা। ওকে মোল্লা মৌলভীরা বুঝিয়েছে- ছেলেকে হাফেজ বানালে দশজনকে সে জান্নাতে নেবে। এবসার্ড! হাস্যকর!! আমার পরামর্শ না শুনে ছেলেকে হাফেজ বানালো- তারপর মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়েছিলো। মাদ্রাসা থেকে এসএসসি পাশ করল তার হাফেজ ছেলে রায়হান। তারপর ওরা অন্য কোথাও চলে গেলো বাসা বদল হলো। আজ প্রায় পনর বছর আগের কথা ওরা চলে যায় ডেমরা এলাকা ছেড়ে। আমিও রিটায়ার্ড হয়ে গ্রামে চলে যাই। আমার হাতেম এইচ এস সি পাশ করে পাবলিক ইউ-নিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিল কিন্তু ওর কপাল খারাপ, কোথাও চান্স হলো না। ওর মনের অবস্থা সহ্য করতে না পেরে গ্রামের দশ শতাংশ জমি বিক্রি করে ওকে ভর্তি করালাম একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে।

কখনও ভাবিনি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে কত টাকা লাগে একটি গ্রেজুয়েট শেষ করতে! অনেক টাকা পয়সা দিলাম ছেলে ইউনিভার্সিটিতে যার কোন হিসেবে মিলাতে পারবো না। পেনশন এর টাকা ছাড়া কোন ইনকাম ছিলনা। ভাগ্য ভালো যে, একমাত্র ছেলে তাই অন্য কারো জন্য চিন্তা করতে হয়নি। ওর মা বলতো- ‘দরকার হলে সব বিক্রি করে দাও ওর লেখাপড়া শেষ হলে ভাল চাকরী পেলে আমাদের আবার সব হবে।’
আমিও কোন দিন কৃপনতা করিনি, শেষমেষ এলএলবি অনার্স শেষ করে ও বলল- ‘বাবা! আমার বন্ধুরা ইউএস এ’তে যাচ্ছে উচ্চ শিক্ষা নেয়ার জন্য।আমি কি যেতে পারবো না?’
কেন যেতে পারবে না বাবা, কি লাগবে বলো? খুব আদর করে বুকে টেনে বলেছিলাম। ‘বাবা! অনেক টাকা লাগবে। কত টাকা?’
‘৩৫ লাখ টাকা বাবা!’
কথাটা শুনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম, ৩৫ লাখ!!!এতো টাকা। কোথায় পাবো, কে দেবে? কিভাবে জোগাবো? ভাবতে ভাবতে কোন পথ যখন পাচ্ছিলাম না তখন হাতেমের মা বলল-‘বেচে দাও আমাদের সব!’
‘মানে কি! কোনটা বেচার কথা বলছো?’
‘এইযে আমাদের ঘরবাড়ি যায়গা জমি যা আছে।’ আবারও চিন্তায় পড়ে গেলাম, কি করবো সব বেচে দিলে আমরা এখন যাবো কই? ভালো কিছু হবে হয়তো হাতেম যখন উচ্চ শিক্ষা শেষ করে দেশে ফিরবে, ভালো চাকরী করবে তখন। কিন্তু এখন থাকবো কই, যাবো কোথায়? সব কিছু যোগ বিয়োগ করে অবশেষে একটি এনজিও থেকে লোন নিলাম। আমাদের সব স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির বিপরীতে চল্লিশ লাখ টাকার লোন পেলাম।

মনে হলো পুরো পৃথিবী জয় করে ফেলেছি, যেদিন আমাদের হাতেম উচ্চ শিক্ষার জন্য আমেরিকা চলে গেলো।
ভাবনার রাজ্যে হাবুডুবু খেতে খেতে ভুলেই গেলেন যে এখনও রাত চারটা। ভোর হতে দেরী, ঘুমোতে হবে।স্ত্রীর হাতের স্পর্শে বাস্তবে ফিরে এলেন যেন, ‘কি ভাবছো?’
‘না কিছু না’
‘ঘুমোও, এখনতো অনেক রাত বাকি!’
‘তোমার কি মনে পড়ে আমাদের হাতেম যখন এইচএসসি পাশ করে পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে চান্স না পেয়ে কি যে মন খারাপ করে বাসায় এলো…!’
বৃদ্ধা আলেয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন, কি সব ভাবছো এতো রাতে, ঘুমাও’
স্বামীকে ঘুমোতে বললেও আলেয়া নিজেই নস্টালজিয়ার আক্রান্ত হয়ে ভাবনার ঘোড়ায় ঘুরতে ঘুরতে চলে যায় সেই পেছনে ফেলা অতীত জগতে। স্বামীর পকেট থেকে নেয়া টাকা অথবা স্বামীর ভালোবেসে গিফট হিসেবে দেয়া টাকাগুলো আদরের হাতেমের হাতেই তুলে দিতেন মা। সেই ছেলে আজ বড় অফিসার, উচ্চ শিক্ষা শেষ করে ঢাকায় বাবা মাকে নিয়ে থাকেন। কিন্তু শান্তি ও স্বস্তি যে কোন অজানা দেশে চলে গেছে সেটা বুঝতে পারছেনা বৃদ্ধা মা। (সংক্ষেপিত)
-বাফেলো, নিউইয়র্ক

Comments


মন্তব্য করুন


আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।