পতাকা উত্তোলন ও বাঙ্গালী মানসিকতা নিয়ে বাফেলোবাংলা’র প্রতিবেদন
জাহান্নামে বাঙ্গালীদের গর্তে নাকি কোন পাহারাদার ফেরেশতা থাকবে না?
পরকালের বিষয়ে কোন বক্তব্য তখনই গ্রহণযোগ্য হয়; যখন তা কুরআন কিংবা সহীহ হাদীসের রেফারেন্সে বলা হয়। জাহান্নামে বাঙ্গালীদের বিষয়টি এমন কোন বৈধ সূত্রে বর্ণিত না হলেও বাঙ্গালী সমাজে প্রবাদটি প্রচলিত। বাংলাদেশীদের আচরণ, স্বভাব এবং মানসিকতা নিয়ে এ উপমাটি বলা হয়ে থাকে। কেন বলেন? বলেন এ কারণে যে, বাংলাদেশীদের অনেকে অপর বাংলাদেশীর ভাল দেখতে পারেননা, তারা পরশ্রী কাতরতায় ভুগেন। অন্যের সাফল্য দেখলে অসুস্থ হয়ে পরেন তাদের অনেকে। তাই বলা হয়ে থাকে যে, পরকালেও জাহান্নামের গর্তে বাংলাদেশীদের জন্য কোন ফেরেশতাকে পাহাড়াদার নিযুক্ত করা হবে না। এ জন্যে যে, একজন বাঙ্গালী জাহান্নামের গর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করলে নীচ থেকে অপর বাঙ্গালী তাকে টেনে নামিয়ে ফেলবে, যা তারা পৃথিবীর জীবনেও অহরহ করতে অভ্যস্ত।
এ ধরনের মানুষদের আরেকটি বৈশিষ্ট হল, তারা নিজের স্বার্থ ছাড়া অন্যের জন্যে কিছুই করেন না বরং অন্যকে ঘাঁয়েল করে নিজেদেরকে আলোচনায় আনতে এবং শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসাতে সদা তৎপর থাকেন। এমনকি তারা আপন স্বার্থ সিদ্ধির লক্ষ্যে ছলচাতুরী এবং মায়াকান্নার মাধ্যমে স্বার্থান্বেষীদের নিয়ে দল ভারি করারও অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। সম্প্রতি বাফেলোতেও এমন মানসিকতার কতিপয় ব্যক্তির তৎপরতা লক্ষ্যণীয়।
বাফেলো শহরে বাংলাদেশী কমিউনিটি দ্রæত বাড়ছে। এর সাথে সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মকতব, বাংলা স্কুল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, আঞ্চলিক সংগঠন থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে বাংলাদেশীদের সম্প্র্রসারণ স্থানীয় প্রশাসন ও অন্যান্য কমিউনিটির দৃষ্টি কেড়েছে। গ্রেটার বাফেলোর বাংলাদেশীরা যে যার ক্ষেত্রে সুনামের সাথে এগিয়ে যাচ্ছেন। আজোবধি একে অন্যকে যতদূর সম্ভব স্বীকৃতি দান, উৎসাহ দিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন। সব কিছুই যে সবার পছন্দমত হচ্ছে কিংবা চিন্তার সাথে মিলে যাচ্ছে এমনটি অবশ্যই নয়; কিন্তু অন্যকে গ্রহণের উদারতার দৃষ্টান্ত বাফেলোতে অনন্য এবং এ বিষয়টিকে কেউ কেউ বাংলাদেশীদের জন্য অনুকরণীয় এক মাইলস্টোন বলেও উল্লেখ করেছেন।
কিন্তু ঐযে পুরনো ক্রনিক ডিজিস- ‘অন্যের সাফল্য দেখে অসুস্থ হয়ে যাওয়া’; কেউ কেউ এমন রোগ আর চাপা দিয়ে রাখতে পারছেন না। তারাই বাফেলোর বাংলাদেশী কমিউনিটিকে দ্বিধাবিভক্ত করতে মিডিয়াতে ‘বিষবাষ্প’ ছড়াচ্ছেন।
কোন এক গ্রামের বুড়ি নাকি অন্যের ভাল দেখে নিজের দাঁতে-দাঁত ঘষতে ঘষতে অবশেষে দাঁতের কোণাই ভেঙ্গে ফেলেছিল। এ ধরনের লোকদের ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক জীবন পর্যালোচনা করলেও ‘দুর্গন্ধময় চিত্র’ বেরিয়ে আসবে।
সম্প্রতি বাফেলোর একজন রেস্টুরেন্ট মালিক বললেন, ‘ভাই রেস্টুরেন্টটি ওপেন করে যেন বিরাট অপরাধ করে ফেলেছি’! কেন প্রশ্ন করতে তিনি বললেন- ‘আমাদের এখানে বিভিন্ন কমিউনিটির মানুষ আসেন; কিন্তু কোন কোন বাংলাদেশী কাস্টমার কোন কারণ ছাড়াই রেস্টুরেন্ট সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এমন সব তীর্যক সমালোচনা করেন যে, তা মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়।’ তিনি বলেন, ‘যখন অন্যান্য কমিউনিটির লোকজন খাবার শেষে ‘নাইস ফুড’, ‘গুড সার্ভিস’, ‘এপ্রিসিয়েটেড’ কথাগুলো বলেন এবং এক গাল হাসি দিয়ে বিদায় নেন, তখন বাংলাদেশী কাস্টমারদের মুখে প্রায়শই শুনতে হয়- ‘ভাই কি রান্না করলেন; তেমন কোন স্বাদ-টাদ পেলাম না’। কিংবা ‘আরে ভাই, এটুকু খাবারের এত দাম!’ ইত্যাদি ইত্যাদি’। রেস্টুরেন্ট মালিক আফসোসের সুরে বললেন- ‘আমরা কি কখনো কারো কোন ভালো দেখি না; নাকি অন্যের স্বীকৃতি দেয়ার বৈশিষ্টই আমাদের মন থেকে হারিয়ে গেছে’?
লউসে’র সিনিয়র পোস্টে কর্মরত একজন বাংলাদেশী দু:খ করে বললেন- ‘আমি কখনোই এ আশা করি না যে, কোন বাংলাদেশী লউসে কেনাকাটার জন্যে আসুক কিংবা এখানে চাকুরীতে জয়েন্ট করুক।’ কেন’র উত্তরে তিনি বললেন- ‘ইতিপূর্বে আমি একটি আইটি কোম্পানীতে জব করতাম। সেখানে কয়েকজন বাংলাদেশীকে চাকুরী পেতে সাহায্য করেছিলাম। যখন তারা চাকুরী পেল কিছুদিনের মধ্যেই দেখলাম এদের দু’একজন ম্যানেজারকে আমার বিরুদ্ধেই অভিযোগ শুরু করে দিয়েছেন। কারণটি ছিল; আমাকে সরাতে পারলেই তারা আমার পোস্ট সহ আরো দু’একটি পোস্ট দখল করতে পারবেন। অবশেষে আমার সহযোগিতায় চাকুরীপ্রাপ্ত বাংলাদেশীদের অভিযোগের কারণেই ঐ কোম্পানী থেকে আমাকে বিদায় নিতে হয়েছে।’
বাফেলো সিটি মেয়র নির্বাচনে বাংলাদেশীরা দু’প্রার্থীর পক্ষেই নির্বাচনী প্রচারণায় স্বেচ্ছাসেবীর দায়িত্ব পালন করেছেন। একপক্ষ বিজয়ী হয়েছে, আরেক পক্ষ পরাজিত। কিন্তু বাফেলোতে এটি একটি ব্যতিক্রম উদাহরণ যে, বিজয়ী প্রার্থীকে যেসব স্বেচ্ছ¡াসেবক সহযোগিতা করেছেন তাদের কেউই নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর পরাজিত বাংলাদেশী স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে কোন ধরনের কটুক্তি করেননি। বরং মোহাম্মদ ওসমান, মোস্তফা জাভেদ, এডভোকেট শহীদুল্লাহ, হাবীবুর রহমান, জনাব মিছবাহ, ময়নুল, রনি, মিজান, মোস্তাক, শাহ, মারুফ, মুরাদ, মাহী থেকে শুরু করে যাঁরাই বিজয়ী মেয়র ব্রাউনের জন্য কাজ করেছেন, তাদের অনেকের মুখে উচ্চারিত হয়েছে যে, ‘ওয়াল্টনের পক্ষের বাংলাদেশীরা আমাদেরই বড় ভাই, আমাদের বন্ধু; আমরা সবাকে নিয়ে একসাথে বাংলাদেশী কমিউনিটির উন্নয়নে কাজ করতে চাই’।
অন্যদিকে, ওয়াল্টনের সাপোর্টারগণও ব্রাউনের স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে কোন ধরনের অভিযোগ কিংবা দোষারোপ করেছেন বলে শোনা যায়নি। অথচ, নির্বাচন ইস্যুকে উসিলা করে কতিপয় সমাজচ্যুত ব্যক্তি মনের মাধুরী মিশিয়ে অবাস্তব, কল্প-কাহিনী ছড়ানোর মাধ্যমে বাফেলোর বাংলাদেশী কমিউনিটিকে দ্বিধাবিভক্ত করার অপচেষ্টায় নেমেছেন।
পর্যবেক্ষকদের মতে, মূল ধারার রাজনীতিবিদ এবং নীতিনির্ধারকগণ এখনো আমাদের কমিউনিটির কেউ নন। তাঁদের পক্ষ-বিপক্ষে কাজ করলে যে আমাদের কমিউনিটির বিরাট কোন উপকার কিংবা ক্ষতি হয়ে যাবে তা এখনো বাস্তব নয়। কেননা, এ দেশের রাজনীতি এবং প্রশাসন চলে ভিন্ন বিশ্লেষণে; ভিন্ন পরিকল্পনায়।
তবে, চরম সত্য যে বিষয়টি; তাহল, মেয়র ব্রাউনের জন্যে যারা মাসের পর মাস নিরলস কাজ করেছেন, মেয়র ব্রাউন তাদেরকেই অন্য সাধারণ থেকে ভিন্ন ভাবে দেখছেন। তাদের প্রতি সিটিহল প্রশাসনের আগ্রহ অনেক বেশি এবং সিটি হলের বিভিন্ন দপ্তরে তাদের এক্সেস অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে অধিক সহজ হয়েছে।
বৃহৎ ক্যানভাসে দেখলে এ অর্জনটুকুও বাংলাদেশী কমিউনিটির জন্যে একটি বড় অর্জন। যাদের ভেতরে ন্যুনতম বিবেচনা আছে তারা বাংলাদেশী কমিউনিটির জন্য সিটি হলের সাথে একটি পথ তৈরি হয়েছে ভেবে এ নিবেদিতপ্রাণ উদ্যোগীদের সামনে এগিয়ে যেতে উৎসাহীত করার কথা; সাথে সাথে তাদেরকে সৎ পরামর্শ দিয়ে আরো বিচক্ষণ হতে, সবাকে নিয়ে তারা যেন একসাথে সুপরিকল্পিতভাবে পরবর্তী পদক্ষেপগুলো নেয় সে পরামর্শ দিবেন এবং নিজেকে সম্ভাব্য সম্পৃক্ত করতে নিবেদিত হবেন। তাহলেই তো বাংলাদেশী কমিউনিটি ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। কিন্তু কতিপয় একচোখা স্বার্থান্বেষী এ অর্জনকে মূল্যায়ণ না করে বরং মিডিয়াতে অসত্য তথ্য প্রচার করছেন।
বাফেলো সিটি হলে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন কর্মসূচিতে উদ্যোগী ভ‚মিকা রেখেছে ‘বাফেলো বাংলা’। বাফেলো বাংলা সম্পাদক নিয়াজ মাখদুম মেয়র বায়রন ব্রাউনকে এ বিষয়ে আবেদন জানালে তিনি তা গ্রহণ করেন এবং যথাযথ ব্যবস্থা নিতে অধীনস্তদের নির্দেশ দেন। বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের অনুষ্ঠানটি ছিল বাফেলো সিটি হলের। তারা বাফেলোবাংলা এবং স্বেচ্ছাসেবকদের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে ১৬ ডিসেম্বর, ২০২১, বৃহস্পতিবার সিটি হলে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের ঘোষণা দেন। অবশেষে গ্রেটার বাফেলোর দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রায় সকল শ্রেণীর বাংলাদেশীদের উপস্থিতিতে, মেয়র বায়রন ব্রাউন বাফেলো বাংলা’র সম্পাদককে সাথে নিয়ে প্রশাসনিকভাবে সিটি হলে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ওয়েস্টার্ন নিউইয়র্কের ইতিহাসে এই প্রথম প্রশাসনিক ভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হলো, যা বাংলাদেশীদের জন্য একটি বড় সাফল্য। কিন্তু পরশ্রীকাতর দু’একজন সামনের কাতারে আসতে না পেরে তাদের গাত্রদাহ শুরু হয়। মনসিক অসুস্থতায় ভুগেন তারা। দুরবীন দিয়ে খুঁজতে শুরু করেন অনুষ্ঠানের দোষ-ত্রæটি। যদিও গ্রেটার বাফেলো সহ অন্যান্য অঞ্চলের অনেকেই বাফেলো বাংলা’র এ উদ্যোগের ভ‚য়সী প্রশংসা করেছেন।
বাফেলো বাংলা’র স্বপ্ল সময়ের এ উদ্যোগকে শুরু ধরে ভবিষ্যতে আরো বড়ো পরিসরে, সবার সম্পৃক্ততায় বাংলাদেশের মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানাদি সিটি হলের সম্পৃক্ততায় করা যেতে পারে। যাঁরা কমিউনিটির উন্নয়ন চান, অগ্রগতি চান এবং মনটাকে উদার করে এগিয়ে আসবেন তাঁরা অবশ্যই সকলের কাছে সমাদৃত হবেন; তাঁদের ত্যাগ স্বীকৃত হবে ইতিহাসে। কোন কোন বাঁকা চোখ, বাঁকা উক্তি, অযোগ্য, স্বার্থপর, সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির মানুষদের সমালোচনা আগেও ছিল, আজো আছে এবং ভবিষ্যতের থাকবে, তা সবাই জানেন।
যারা ঘরে বৌ পিটিয়ে সমাজকে উপদেশবাণী শোনান, তাদের নীতিবাক্য শুনে দু:খ এবং ঘৃণা ছাড়া আর কিইবা অনুভূত হতে পারে? আসুন, কমিউনিটিকে দ্বিধাবিভক্ত করার মানসিকতাসম্পন্নদের পাশ কাটিয়ে যাই; তাদেরকে ‘আসসালামু আইকুম’ বলি এবং বাফেলো বাংলাদেশী কমিউনিটির উন্নয়নে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যাই। সুন্দর এবং সাফল্যকে জানাই জয়ধ্বনি। জাহান্নামের তলদেশে টেনে নামানোর মানসিকতা পরিত্যাগ করি আজই।
Comments